সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে ভাগ্য বদলাচ্ছে কুষ্টিয়ার নারীরা
কুষ্টিয়া, ৩১ জানুয়ারি: বাবা অসুস্থ, মাও বিছানায় পড়ে আছে। অভাব অনটনের মধ্যে জীবন কাটছিলো রাইকা খাতুুনের। তখন থেকেই ভাবছিলেন কিছু একটা করার। অনেক জায়গায় কাজের জন্য গেলেও কাজ পাচ্ছিলেন না। এরপর পরিচিত একজনের মাধ্যমে সমাজ সেবার দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যান তিনি। সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন সেখানেই কাজ করছেন। পাশাপাশি বাড়িতেও পোশাক সেলাই করেন। এতে যেমন নিজে স্বাবলম্বী হতে পেরেছেন, তেমনি মা-বাবার পাশেও দাঁড়াতে পেরেছেন রাইকা খাতুন।
কুষ্টিয়ার সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়া নারী উদ্দোক্তা রাইকা খাতুনের মতো মতো অনেক অস্বচ্ছল নারীই নিজের ভাগ্য বদলাচ্ছে। বিনা খরচে প্রশিক্ষণ শেষ করে সেখানেই কর্মসংস্থানের সুযোগ পাওয়া এক একজন হয়ে উঠছেন নারী উদ্দোক্তা।
শহর সমাজসেবা সমন্বয় পরিষদের ব্যাতিক্রমী এই উদ্যোগে নারীরা তৈরি করছেন জিরো সাইজ থেকে ছয় মাস বয়সী শিশুদের অত্যাধুনিক মানের পোশাক। প্রতিমাসে আনুমানিক ৪ হাজার শিশুর পোশাক প্রস্তুুত করছেন সমন্বয় পরিষদের আওতাধীন নারী কর্মীরা। সমাজসেবা সমন্বয় পরিষদের অর্থায়নে এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সেলাই, প্যাকেজিং ও বাজারজাতের উপযুক্ত করা পর্যন্ত পোশাক প্রতি ২০ টাকা করে পারিশ্রমিক পাচ্ছেন তারা। শহরের আমলাপাড়ায় অবস্থিত দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ৩ জন প্রশিক্ষক এবং ১৩ জন নারী কর্মী প্রতিদিন শিশুদের পোশাক তৈরিতে কাজ করছেন। প্রতিদিন একজন কর্মী প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা উপার্জন করতে পারছেন। এতে স্বাবলম্বী হচ্ছে অসহায়, গরীব ও বিধবা নারীরা।
গোটা দেশে মোট ৮০ টির বেশি সমন্বয় পরিষদ রয়েছে। কিন্তু এই রকম ব্যাতিক্রমধর্মী উদ্যোগ কুষ্টিয়াতেই প্রথম নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রটি ঘুরে দেখা যায়,প্রশিক্ষকরা উন্নত মানের কাপড় ডিজাইন করে সেগুলো কেটে দিচ্ছেন। আর সেই কাটা কাপড়গুলো সেলাই করে,বোতাম লাগিয়ে,প্যাকেজিং করছেন নারী কর্মীরা। প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ২৫ টি পোশাক সেলাইয়ের কাজ সম্পন্ন করতে পারেন একজন নারী শ্রমিক।
জানা গেছে, ২০২১ সাল থেকে এই কার্যক্রম শুরু করেছে কুষ্টিয়া শহর সমাজসেবা সমন্বয় পরিষদ। প্রথমে পায়ে চালানো সেলাই মেশিন দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু করলেও এখন প্রায় ১২ টি অটোম্যাটিক ডিজিটাল সেলাই মেশিনে এই কাজগুলো করছেন কর্মীরা। নতুন ডিজাইনের পোশাকের চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে পোশাকের অর্ডার পাচ্ছেন তারা।
চলতি মাসে সূর্যের হাসি নেটওয়ার্ক থেকে ৬ হাজার ৯১৭ পিস পোশাকের অর্ডার পেয়েছেন তারা। এর আগে ৩ হাজার ৩৫৮ পোশাক তৈরির অর্ডার সেখানে দেয়া হয়েছিল। ৬ মাস অন্তর বছরে ২ বার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে শহর সমাজসেবা সমন্বয় পরিষদ। প্রতিবারে ১০০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
প্রশিক্ষণ নিয়ে সেখানেই কর্মরত নারীকর্মী ও উদ্দোক্তা রাফেজা ইসলাম বৈশাখী বলেন, ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল কাজ শেখার। সমাজসেবা থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়েছি। তারা আমাকে সার্টিফিকেট দিয়েছে। এখন এখানে কাজ করেই প্রতিমাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করছি। এর পাশাপাশি নিজ উদ্যোগেও পোশাক তৈরির কাজ করি। এখন আমি নিজেও স্বাবলম্বী, অন্যদেরকেও সেলাই কাজে সহায়তা করছি।
পরিষদের প্রধান প্রশিক্ষক হাসনা জাহান বলেন, প্রথম অবস্থায় আমরা ৬ জন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। এখন আমাদের কর্মী ১৩ জন। এদের মধ্যে ১০জন অফিসে এবং তিনজন বাড়ি থেকেই কাজ করেন। এখান থেকে একজন নারী কর্মী সর্বোচ্চ ১৩ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। কর্মীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে এখানেই কাজের সুযোগ পেয়েছে।
কুষ্টিয়া শহর সমাজসেবা সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও শহর সমাজসেবা অফিসার মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, আগে ম্যানুয়াল মেশিনে সেলাই প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। ২০২১ সাল থেকে এই কার্যক্রমকে আরো বেগবান করার চেষ্টা করেছি। সে সময় প্রথম জাপান টোবাকোর প্রায় ২৫ জন চাষী পরিবারের নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। পরে আমাদের সাথে সূর্যের হাসি নেটওয়ার্ক যোগাযোগ করেন। তারা জিরো সাইজ থেকে ছয় মাসের শিশুদের ৬০০ পিস পোশাকের অর্ডার দেয়। তারপর আবারও ৩ হাজার ৩০০ পিস পোশাকের অর্ডার দিয়েছে। বর্তমানে আমরা প্রায় ৭ হাজার পিসের অর্ডার নিয়ে কাজ করছি।
তিনি বলেন, সমাজ সেবা থেকে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তাদেরকে আমরা শুধু সনদ দিয়েই ছেড়ে দেয়নি। তাদেরকে মনিটরিং করেছি, যোগাযোগ রেখেছি। এদের মধ্যে ভালো কর্মীদের বাছাই করে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছি। এখানে কাজ করার পাশাপাশি যারা উদ্দোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তাদের স্বপ্ন পূরণে আমরা বিনিয়োগও করেছি।