আপনি মনে করুন মালিবাগ বা মগবাজার এলাকায় থাকেন। জানতে পারলেন চিড়িয়াখানা থেকে বনের রাজা সিংহ মশায় ছুটে পালিয়েছে। এই মুহূর্তে মৌচাকে রয়েছে। আপনি যদি নিতান্ত পাগল না হন তাহলে কি মৌচাক মুখো হবেন?
সিংহ সম্পর্কে যে জানে সে কখনও সাহস করবে না সিংহের মুখোমুখি হওয়ার। বনের পশুদের ভেতর সবচে’ শক্তিশালী হিসেবে সিংহের নামডাক রয়েছে আদিকাল থেকেই। বাঘ না সিংহ কে বেশি শক্তিশালী এ নিয়ে এক বিতর্ক আছে।
আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগার হয়ত সিংহের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। কিন্তু রাসূল সা. যখন ভাইরাসাক্রান্ত মানুষ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তখন রয়েল বেঙ্গল টাইগার প্রজাতি হয়ত অস্তিত্তেই আসেনি।
মূলত নবীজী সা. সে সময়ের মানুষ যেভাবে বুঝবে সেভাবেই বুঝিয়েছেন। বীরত্ব ও শক্তি বোঝানোর জন্য সিংহকেই রূপক হিসেবে ব্যবহারের রীতি ছিল আরবি ভাষায়। আরবি অলঙ্কার শাস্ত্রের বইগুলোতে যায়দুন কালআসাদি উদাহরণ দেয়া হয়। অর্থাৎ সিংহের মতো বীর।
সিংহের যে নামডাক বা খ্যাতি তা বাদ দিলেও স্বাভাবিকভাবে পশু সমাজে সিংহের হিংস্রতা সমীহ জাগানোর মতো। এ জন্যই যে কোনো সাধারণ পাঠক বুখারী শরীফের হাদীসটি যখন এতকাল পড়েছে তার কাছে অবাক বিস্ময়ের মনে হয়েছে, রাসূল সা. ভাইরাস থেকে পালানোর কথা বলতে গিয়ে এমন অতিরঞ্জিত কথা বললেন কেন? ভাইরাসকে এত বেশি ভয় পাওয়ার কী আছে?
এ হাদীসটি পূর্ণরূপে বোঝার জন্য হয়ত করোনাভাইরাস পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার প্রয়োজন ছিল। করোনাভাইরাস আমাদের যে সব উপকার করেছে তার ভেতর এটিও হয়ত অন্যতম একটি। অনেক হাদীসের ব্যাখ্যা আমাদের সামনে নতুনভাবে উন্মোচিত হয়েছে।
সত্যি এটা ভাবার মতো বিষয়। ভাইরাসাক্রান্ত মানুষ থেকে সতর্ক থাকতে নবীজী আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর আগে এমন সুন্দর একটি ভাষা ব্যবহার করেছেন।
সিংহকে আরবী ভাষায় বীরত্বের প্রতীক হিসেবে ব্যবহারের চল ছিল। অথচ সিংহ হচ্ছে প্রকৃত প্রস্তাবে ভয়ংকর হিংস্র এক প্রাণী। রাসূল সা. সেই হিংস্র প্রাণীর ভয়ংকর রূপটিকেই ব্যবহার করেছেন বুখারীর উক্ত হাদীসে।
বর্তমান করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর মানুষ ভাইরাসকে যেভাবে বুঝতে পারছে এর আগে কেউ সেভাবে বুঝতে পারেনি। মিরপুরের টোলারবাগ যখন লকডাউন হল তখন কেউ সেদিকে যাওয়ার দুঃসাহস করতে পারে না। এ যেন হিংস্র বেপরোয়া জন্তু থেকে বেঁচে থাকতে চরম সাবধানতার একটি নজির।
আমেরিকা যাওয়ার জন্য মানুষ এক সময় কত চেষ্টা-তদবির করেছে। সাধারণ বাঙালি কেউ আমেরিকায় গমনের স্বপ্ন দেখারও সাহস করতে পারত না। আমেরিকার উন্নতি ও বিরাট ভাবমূর্তির কারণে। কোটি টাকা খরচ করেও যদি কেউ আমেরিকা যেতে পারত তাহলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করত।
আজকে কাউকে যদি কোটি টাকা দিয়ে বলা হয় তুমি নিউ ইয়র্ক থেকে ঘুরে এসো। উন্মাদ ছাড়া কেউ সেখানে যেতে প্রস্তুত হবে বলে মনে হয় না।
করোনাভাইরাসের চতুর্থ স্তরে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। মার্চের ৮ তারিখে প্রথম করোনা রুগী শনাক্ত হয়েছে আমাদের দেশে। এপ্রিলের ৮ তারিখ পার হয়ে গেল। আমরা ইতালি, স্পেন ও আমেরিকাকেই যেন অনুসরণ করছি। তার মানে সামনে আমাদেরও দুর্দিন অপেক্ষা করছে।
আগামী মে মাসের ৮ তারিখে আমাদের কী দশা হবে আল্লাহই জানেন। হয়ত আমাদের দেখতে হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশ। যা আরও বেশি ভয়াবহ এবং দুর্যোগপূর্ণ হবে। আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে হয়ত আরও কঠিন অকল্পনীয় কষ্টের মুহূর্ত।
এই এখনও আমাদের দেশ গ্রাম এবং শহর বা মফস্বলেও সাধারণ মানুষের ভেতর সতর্কতা দেখা যাচ্ছে না। পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ায় যথেষ্ট সতর্ক সাবধান করা হচ্ছে, কোনো কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। মসজিদগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতকিছুর পরও জনসমাগমগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না। খুবই দুঃখজনক পরিস্থিতি। যারাই সতর্ক করছে তাদের দুশমনিতে নেমে পড়ছে মানুষ।
আমার পরিচিত একাধিক আলেম আমাকে বলেছেন, এ সময় অন্য সব জনসমাগম বন্ধ করে তারপর মসজিদ বন্ধ করা উচিত ছিল। আমি তাদের বললাম, গার্মেন্টস, বাজার বা অন্য সব জনসমাগম বন্ধ করা হলে আমরা মসজিদ বন্ধ করব এটা কোন্ হাদীসের ভিত্তিতে বলছেন? তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো হাদীস নেই।
শরীয়তের বিধান নিয়ে এ কী খেলা শুরু হয়েছে? অন্যের সঙ্গে তুলনা করার কী আছে? শরিয়ত তার নিজস্ব গতিতে চলে। রাসূল সা. বলেছেন, তুমি অন্যের অনুগামী হইও না, অমুক আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে আমিও তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করব, এ মানসিকতা পরিত্যাজ্য।
বরং সে তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলেও তুমি ভালো ব্যবহারই করবে। [তিরমিযি]
মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর সারা বিশ্বের সব বিদগ্ধ সচেতন আলেম একমত হয়ে ফতোয়া দিয়েছেন মসজিদে নামাজ না পড়ে ঘরে নামাজ পড়ার বিষয়ে। তারা যে হাদীসের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্তে এসেছেন সেখানে এ কথা নেই যে গার্মেন্টস বা বাজারের অবস্থার উপর ভিত্তি করে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ইবন উমর থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. প্রচুর ঠাণ্ডা বা বৃষ্টির দিনে মুআজ্জিনকে দিয়ে ঘোষণা দিতেন, আলা সাল্লু ফি বুয়ুতিকুম। লোক সব তোমরা যার যার ঘরে নামাজ পড়ে নাও। [বুখারী, মুসলিম]
কোনো কোনো বর্ণনায় সফরের কথা থাকলেও অন্য বর্ণনায় সফর ছাড়া সাধারণ সময়ের কথাও রয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, রাসূল সা. এ সব হাদীসে বলেননি যে, দেখ, যদি বাজারগুলো বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তোমাদের জন্য এ বিধান, তা না হলে তোমাদের মসজিদেই আসতে হবে।
আল্লাহ ছাড়া কোনো কিছুকে আমরা মুসলমান ভয় পাই না। করোনাভাইরাসকেও এ জন্য ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আল্লাহই আমাদের রক্ষা করবেন। এমন কথা ছড়িয়ে দিয়ে খুব মজা পাচ্ছেন কিছু মানুষ।
নিজেদের দৃঢ় ইমানের পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে। তারা বুঝতে পারছেন না যে, এই করোনাভাইরাস আল্লাহ তায়ালারই প্রেরিত। কাজেই তা থেকে রক্ষা পেতে আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।
আল্লামা রুমি রহ.-এর গল্প দিয়ে শেষ করব নিবন্ধ। মসনবী শরীফে মাওলানা রুমি লিখেন, একবার প্রচণ্ড ঝড়ের সময় এক ব্যক্তি একটি বড় গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। এক লোক তাকে এসে সাবধান করে বলল, ভাই ঝড়ের সময় বজ্র পড়লে এখানেই এসে পড়ে আগে, এখান থেকে সরে দাঁড়াও।
সে বলল, আল্লাহ আমার রব, তিনিই আমাকে বাঁচাবেন। কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় আরেকজন এসেও তাকে সতর্ক করল। সে এবারও একই উত্তর দিল, আল্লাহর উপর আমার পূর্ণ তাওয়াক্কুল রয়েছে। আল্লাহই আমাকে বাঁচাবেন।
কিছু পরে তৃতীয় আরেক ব্যক্তি এসে একইভাবে সতর্ক করল। গাছের নিচে দাঁড়ানো লোকটা উত্তরে বলল, তোমাদের তো আল্লাহর উপর ভরসা নেই, আমি আমার মাওলার উপর পূর্ণ ভরসা রাখি। আমার মালিক আমাকে অবশ্যই রক্ষা করবেন।
তৃতীয় লোকটি সেখান থেকে চলে যাবার পরপরই আকাশ থেকে একটি বজ্র পড়ে লোকটি মারা গেল। চতুর্থ আরেকজন আল্লাহর বান্দা এ পুরো দৃশ্য দেখছিলেন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, কিছুই বুঝতে পারলাম না, আল্লাহর উপর তার এমন ভরসা অথচ আল্লাহ তাকে রক্ষা করলেন না?
আল্লামা রুমি কাব্যের ভাষায় লেখেন, ‘মূলত আল্লাহ তাকে তো বাঁচাতেই চাচ্ছিলেন। এ জন্য ঐ তিনজনকে আল্লাহই পাঠিয়ে ছিলেন। লোকটি অজ্ঞতার কারণে এমন হঠকারিতা করেই মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়।’
করোনাভাইরাসের সময়ে এখনও যারা এমন তাওয়াক্কুলের কথা বলে যাচ্ছেন তাদের এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে বলব। বিশ্ব মিডিয়া, স্বাস্থ অধিদফতর, চিকিৎসক, সরকার যে সব সতর্কতার কথা বলছে তা অবলম্বন করুন। সতর্ক হন সাবধান হন। ঘরবন্দি থাকুন।
নিয়ম মেনে চলুন। ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে অসতর্ক হবেন না। সঠিক বিষয় না বুঝে ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঁচতে পারবেন না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। আমীন।
লেখক: মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ ও খতিব, মসজিদে মদীনা, বাড্ডা।